বাংলাদেশের পানিসম্পদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন যে, আন্তদেশীয় নদ-নদীর পানি বিষয়ে ভারত শুধু নিজেকে নিয়েই চিন্তিত। গত ১৬ই নভেম্বর নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় তিনি এ আক্ষেপ করেন। ভারতের কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিজ (সি আই আই) আয়োজিত পানি উদ্ভাবন শীর্ষক সম্মেলনে তিনি বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখছিলেন। তিনি ফারাক্কা ও গজালডোবা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের গংগা (পদ্মা) ও তিস্তা নদীতে পানি প্রবাহের মারাত্মক হ্রাসের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন যে, পানি সম্পদের যৌথ ব্যবস্থাপনার কথা মুখে বললেও ভারত কার্যত বাংলাদেশের ন্যায়সংগত স্বার্থের দিকে তেমন নজর দিচ্ছে না।
বেন আনন্দিত যে, বাংলাদেশের পানি সম্পদ বিষয়ক মন্ত্রী অভিন্ন নদ-নদী বিষয়ে ভারতের আচরণ সম্পর্কে একটি সত্য কথা সাহসের সাথে উচ্চারণ করেছেন। ১৯৪৭ সনে দেশ বিভাগের পর থেকে ভারত এককভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ফারাক্কার কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদীসমূহ আজ মৃত কিংবা মৃতপ্রায়। গজালডোবা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের বহুল ব্যয়ে নির্মিত তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প আজ প্রায় অকেজো। ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবাহিত ৫২ নদ-নদীর প্রত্যেকটির উপর ভারত পানি প্রত্যাহার কিংবা নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো হয় নির্মাণ করেছে, কিংবা করছে, অথবা নির্মাণের পরিকল্পনা করছে।
বাংলাদেশের সাথে নদ-নদী বিষয়ে দশকের পর দশক এরূপ বৈরী আচরণের পর এখন যখন চীন ব্রহ্মপুত্র নদের পানি প্রত্যাহারমূলক প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, তখন চীনের সেসব প্রকল্পের বিরোধীতায় ভারত বাংলাদেশকে তার সাথে চাচ্ছে। পরিহাস আর কাকে বলে?
পরিতাপের বিষয় যে, অভিন্ন নদ-নদী বিষয়ে স্বীয় স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশের সরকারসমূহ বরাবরই দুর্বলতার পরিচয় দিচ্ছে। ভারতের দাবী মেনে নিয়ে এ বিষয়ে বাংলাদেশ নিজেকে কেবল ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক কাঠামোতে সীমাবদ্ধ রেখেছে। এই দ্বিপাক্ষিক কাঠামোর অধীনে ভারত কেবল স্বীয় অভিরুচী বাংলাদেশের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। অথচ, ১৯৯৭ সনে আন্তর্জাতিক নদ-নদীর ব্যবহার সম্পর্কিত কনভেনশন গৃহিত হয়েছে। সম্প্রতি পর্যাপ্ত সংখ্যক দেশের সাক্ষর পাওয়ায় এই কনভেনশন আইনী মর্যাদাও পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ আজও এই কনভেনশন সাক্ষর করেনি, এবং স্বীয় স্বার্থ রক্ষায় এ কনভেনশনের ধারাসমূহ প্রয়োগের কোন উদ্যোগ নেয় নি।
ট্রানজিটের ইস্যু নিয়ে নদ-নদীর বিষয়ে ভারতের সাথে দর কষাকষির একটা সুযোগ ছিল। বেনের পক্ষ থেকে “নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট” প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছিল। এই প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট সুযোগ দিবে (প্রয়োজনীয় মাশুল ও অন্যান্য শর্তাদি সাপেক্ষে); বিনিময়ে ভারত অভিন্ন নদ-নদীর উপর নির্মিত সকল কাঠামো অপসারণ করে নিবে এবং এসবের পূর্বতন স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে দেবে। পরিতাপের বিষয় যে, বাংলাদেশ এই প্রস্তাবের গুরুত্ব অনুধাবনে সমর্থ হয় নি; এবং এখন নদ-নদীর ক্ষেত্রে ভারতের কোন ছাড় ব্যাতিরেকেই ভারতকে ট্রানজিটের সুযোগ দিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশের পূর্বেকার পানি বিষয়ক মন্ত্রীগণ দেশের জনগণকে হতাশ করেছেন। তারা কেবলই ভারতের মন্ত্রীদের দেয়া ফাঁকা আশ্বাসে সন্তুষ্টি খুঁজেছেন। কিছু বছর আগে বাংলাদেশের তদানিন্তন পানিসম্পদ মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি দল বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণ করবে কীনা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে তিপাইমুখ বাঁধ পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। কথিত দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে তাঁরা দিল্লী থেকেই দেশে ফেরত আসেন। অবশ্য তিপাইমুখ না যেতে পারলেও এই প্রতিনিধিদলের একটি বড় অংশ এই সুযোগে আজমীর ঠিকই যেতে পেরেছিলেন। এ থেকেই নদ-নদীর উপর বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশের মন্ত্রী ও অন্যান্য নীতি নির্ধারকদের আন্তরিকতা ও প্রয়াসের মাত্রার পরিচয় পাওয়া যায়।
উপর্যুক্ত পটভূমিতে বর্তমান মন্ত্রী যে দিল্লীতে যেয়ে বাংলাদেশের প্রতি নদ-নদী বিষয়ে ভারতের আচরণ বিষয়ে একটি সত্য কথা বলেছেন, সেজন্য বেন তাকে সাধুবাদ জানায়। ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিয়ে যদি বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে, তবে নদ-নদীর ইস্যুতে কেন বাংলাদেশ কেবল দ্বিপাক্ষিক কাঠামোতে সীমাবদ্ধ থাকবে, তা স্পষ্ট নয়। নদ-নদী বিষয়ে ভারতের সাথে দর কষাকষিতে বাংলাদেশ কিছু মেরুদন্ডের পরিচয় দেয়া আবশ্যক। বেন আশা করে যে, মাননীয় মন্ত্রী কেবল এক বক্তৃতাতে নিজের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ রাখবেন না। নদ-নদীর বিষয়ে ভারতের আচরণ পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের আরও যেসব করণীয় সেগুলো সম্পাদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনাক্রমে একটি পূর্নাংগ পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন, এবং তা বাস্তবায়নে অগ্রসর হবেন। দেশের সকল পরিবেশ-দরদী সংগঠন ও জনগণ এই প্রয়াসকে সমর্থন জানাবে।